যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের তুলনায় বাংলাদেশে ধর্ষণ কম: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের তুলনায় বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা কম বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। সিরডাপে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) বিকল্প প্রতিবেদন-২০২২ এর ওপর জাতীয় পর্যায়ের মতবিনিময় সভা ছিল। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আয়োজনে সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় মন্ত্রী ধর্ষণের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বলেন, বাংলাদেশে ২০২০ সালে প্রায় ১৫০০ ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, এটা রিপোর্টেড রেপ। এখানে যাতে একটি ধর্ষণের ঘটনাও না ঘটে সেজন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির বিধান করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমেরিকায় একই সময়ে (২০২০ সালে) ১ লাখ ২৯ হাজার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ওই বছরে বৃটেনে ঘটেছে ২৬ হাজারের মতো ধর্ষণের ঘটনা। মন্ত্রী বলেন, ওদের লোকসংখ্যা আমাদের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। তাই তাদের তুলনায় আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি।
তবে একটা ধর্ষণও কাম্য নয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সামাজিক আন্দোলন ছাড়া ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, গত বছর আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স (অ্যামচেম) এর অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ ৯ গুণ বেশি হয় বলে দাবি করেছিলেন। সে সময় ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ডটকম নামে একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত ‘রেপ স্ট্যাটিসটিক বাই কান্ট্রি ২০২০’- শীর্ষক সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন মন্ত্রী।
এদিকে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সূচনাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমি আজ একটি সুখবর দিতে চাই। এখন থেকে আমরা প্রতিবছর ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় প্রবাসী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেন এই দিবস? এর ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলে, প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের জন্য কাজ করে চলেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। আমরা চাই তারা এ দেশের উন্নয়নের সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হোক। সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে আমরা প্রতিবছর ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় প্রবাসী দিবস পালন করবো। মন্ত্রী বলেন, কোনো কোনো ক্রিটিক (সমালোচক) বলছেন ১৮ই ডিসেম্বর অভিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে। এখন প্রবাসী দিবস কেন? মন্ত্রী বলেন, ওই দিবসটি মাইগ্র্যান্টদের জন্য। কিন্তু আমাদের যে ১ কোটি ২০ লাখ প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছেন, তাদের সম্মান জানাতে আমরা প্রবাসী দিবস পালন করবো। সিআইপি সম্মাননার মতো যেসব প্রবাসী সর্বাধিক রেমিট্যান্স পাঠান, তাদের বিশেষ সম্মাননা দেয়া হবে কি না? জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যারা বেশি রেমিট্যান্স পাঠান তাদেরকে অবশ্যই আমরা সম্মান দেবো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা বৃদ্ধিতে দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিং জোরদারে সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছে? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, টেলিভিশনে আমরা দেখেছি চীনের ৪ জন নাগরিকের করোনা শনাক্ত হয়েছে। তবে আমরা কোনো বন্দরে স্ক্রিনিংয়ের বিষয়ে নতুন করে কোনো কাজ করিনি। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন কোনো নির্দেশনা দিলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মন্ত্রী যা বলেন- এদিকে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে নারীর ভূমিকা জোরদারকরণ বিষয়ক রেজ্যুলেশন ১৩২৫ বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৯ সালে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। এই জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন, বিরোধ নিষ্পত্তি, শান্তিরক্ষা, শান্তি বিনির্মাণ, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের সক্রিয় ও অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের নারীরা ইতিমধ্যে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে ৫২১ জন নারী শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। দেশে দুর্যোগ উদ্ধার ও পুনরুদ্ধারের জন্য নিয়োজিত মোট স্বেচ্ছাসেবকদের এক-তৃতীয়াংশই নারী। এছাড়া, সহিংস চরমপন্থাসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় নারীদের প্রতিরোধমূলক ভূমিকা অপরিহার্য। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ড. মোমেন আরও বলেন, প্রতিটি কন্যাশিশু যেন বৈষম্যহীনভাবে সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, আমাদের সকলের সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে আমরা যে এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি সাধন করেছি, সেটি আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ।
মন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের জন্য জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সকল প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়নে বাংলাদশের জনগণ, নাগরিক সমাজ ও সরকার একসাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাবে। সিডো সনদের অর্থপূর্ণ বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বিশেষভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনীতি, কূটনীতি, শিক্ষা, বিচার, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী, পুলিশ, সেবা, ব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র নারীর অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। সরকার যুগোপযোগী নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করেছে এবং সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নিয়েই এ নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশ নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে উন্নতির দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থা করছে, এবং বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। মন্ত্রী বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত ব্যতীত কার্যকর অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। তাই, নারীদের দেশের অর্থনীতে সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বাজেট গ্রহণ করা হয়েছে। দরিদ্র গর্ভবতী মা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা এবং কৃষিকাজে নিয়োজিত প্রান্তিক নারী কর্মীদের ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। ভাতা প্রদানের পাশাপাশি মা ও শিশু-স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তবে, সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার জন্য শুধু আইন প্রণয়ন করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে নারীকে মুক্তি সম্ভব নয়। আইনের কার্যকর প্রয়োগে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী-পুরুষ সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।