সারাদেশ

নিখোঁজের পাঁচ বছর পর ফিরে জানালেন ভারত-লিবিয়ায় রোমহর্ষক নির্যাতনের কথা

পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকা যশোরের বাঘারপাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেন বাড়ি ফিরেছেন। দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাচারের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ভারত ও লিবিয়ায় ভোগ করেছেন নির্মম নির্যাতন। বাড়ি ফিরে জানালেন তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্মন্তুদ ঘটনা।

জাহাঙ্গীর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকুলা গ্রামের মৃত মাজেদ বিশ্বাসের ছেলে। পেশায় ছিলেন ভাঙারি ব্যবসায়ী। তাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তার পরিবার। তবে দেশে ফিরে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। মায়ের দিনমজুরির টাকায় চলছে চিকিৎসা।

তার অভিযোগ, উন্নত জীবন ও ভালো উপার্জনের স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৭ সালে তাকে পাচার করেছিলেন একই গ্রামের গহর শিকদারের ছেলে মানিক মিয়া।

জাহাঙ্গীর জানান, পরিবারের কাউকে কিছু না বলে মানিকের প্রস্তাবে বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশে। মানিক তাকে খুলনার শিরোমনি এলাকার বাগুনবাড়িয়া গ্রামের মোসলেম মিঞার ছেলে ইলিয়াসের (মানিকের শ্যালক) কাছে পাঠিয়ে দেন। তারপরের দিন দালালের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরকে ভারতের মথুরা এলাকার দাউজিবাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই অবৈধভাবে বসবাস করে ইলিয়াসের পরিবার। ভারতে নির্মম নির্যাতনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জাহাঙ্গীর তুলে ধরেন মর্মন্তুদ ঘটনা।

ভারতের মথুরা পর্ব

মথুরায় নিয়ে তাকে ভাঙারি সংগ্রহের কাজে লাগায় ইলিয়াসের পরিবার। প্রতিদিন ৪০ কেজি ভাঙারি না পেলে ইলিয়াসের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে মিলে শুরু করত নির্যাতন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোহার রড দিয়ে পেটাত। সেদিন খেতেও দিত না। এভাবেই কেটে যায় প্রায় এক বছর।

জাহাঙ্গীর বলেন, ২০১৮ সালে এক রাতে ইলিয়াস, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে ঝগড়া করছিল। একপর্যায়ে তিনজন (স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে) মিলে ইলিয়াসের গলা টিপে ধরে। কিছুক্ষণ পর সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর তিনজন মিলে ইলিয়াসকে ধরাধরি করে পাশের জঙ্গলে কবর দেয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমি দেখে ফেলেছি এটা ওরা সন্দেহ করতে থাকে। আমাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে মুম্বাইয়ের দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। দালাল অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লিবিয়া পাঠিয়ে দেয়। জ্ঞান ফিরলে দেখি সবকিছুই অপরিচিত। পরে জানতে পারি সাত লাখ টাকায় আমাকে লিবিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

লিবিয়া পর্ব

লিবিয়ায় একটি শ্যাম্পু উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে সুইপারের কাজ দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরকে। থাকতে দেওয়া হয়েছিল শ্রমিকদের জন্য নির্মিত বোর্ডিংয়ে। ঘরটি ছিল অন্ধকার ও নোংরা।

বিশাল কারখানার যাবতীয় নোংরা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাই ছিল দৈনন্দিন কাজ। নির্ধারিত কাজ শেষ করতে না পারলে শুরু হতো নির্যাতন। চড়, থাপ্পড় লাথি কিল ঘুষি ছিল নৈমিত্তিক বিষয়। তিনবেলা খাবার ছাড়া জুটত না আর কিছুই। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পোশাক চেয়ে নিয়ে পরতে হতো তাকে। এ সময় প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু জোটেনি কোনো স্বাস্থ্যসেবা।

এভাবে চলে প্রায় এক বছর। তিনি ভাবলেন, এভাবে চললে এক সময় মারা পড়বেন। তাই পালানোর কথা ভাবতে লাগলেন জাহাঙ্গীর।

বাড়ি ফেরা

সুযোগ বুঝে একদিন টহলরত লিবিয়া পুলিশের কাছে ধরা দেন জাহাঙ্গীর। নিজেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী পরিচয় দিয়ে বিস্তারিত খুলে বলেন। জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে। বিনা বিচারে চার বছর জেল খাটার পর লিবিয়া সরকার ভারতের মুম্বাই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে জাহাঙ্গীরকে। মুম্বাইয়ের জেলখানায় তিন রাখা হয়। এরপর তাকে কলকাতার দমদম জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে জাহাঙ্গীরকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন কলকাতার আদালত। কারাবাস শেষ হলে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাকে। এরপর গত ২ ডিসেম্বর ভোর চারটায় বাঘারপাড়ার চৌরাস্তায় সাতক্ষীরা পুলিশ তাকে মুক্তি দেয়।

মায়ের কান্না

জাহাঙ্গীর যখন ফেরেন তখন মা নবিরন নেছা বাড়ি ছিলেন না। কিছুক্ষণ পর এসে দেখেন অনেক লোক। ভিড় দেখে তার কিছুটা ভয় হয়। কোনো অঘটন ঘটলো না-তো! পরে দেখেন রুগ্ন ছিপছিপে এলোমেলো লম্বা চুল-দাড়িতে ভরা একজন বৃদ্ধ একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে ঘিরে ধরে আছে প্রতিবেশীরা। দৃষ্টি বিনিময় হয় মা-ছেলের। এক মুহূর্তের সংশয়। এরপরই মা বুঝতে পারেন, এই তার হারিয়ে যাওয়া জাহাঙ্গীর। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন নবিরন নেছা।

তিনি বলেন, আমার ছেলেকে আমিই চিনতে পারিনি। দেখে পাগলের মতো মনে হচ্ছিল। সেই সকালবেলা বাজারে এসে ছেলের চুল-দাড়ি কেটে নিজের হাতে যত্ন করে ছেলেকে খাইয়েছি।

তিনি আরও বলেন, যারা আমার ছেলের এই অবস্থা করেছে তাদের বিচার চাই।

তিনি আরও বলেন, আমার বসতবাড়ি (৪ শতাংশ জমি) ছাড়া আর কোনো জমাজমি নেই। অন্যের বাড়িতে বা রাস্তায় কাজ করে যা পাই তাই দিয়েই চলে সংসার। ছেলে শূন্য হাতে ফিরেছে এবং সে মানসিকভাবে সুস্থ নেই। তাকে চিকিৎসা করাতে হবে। ক্ষতিপূরণের মামলা করব ওদের (মানিক) বিরুদ্ধে।

বাঘারপাড়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ উদ্দীন জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Back to top button