অপরাধ চিত্র

কমিশন বাণিজ্য করতেন সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের ভাই: পুলিশ

নিউজ ডেস্কঃ সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফরিদপুরের সবধরনের টেন্ডার থেকে কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আপন ছোট ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে ফরিদপুরের আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বাবর।

গত ৮ মার্চ দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ বলেন, খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর ২ হাজার কোটি টাকা অর্থপাচারের মামলায় চার্জশিটভুক্ত একজন আসামি। তিনি দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ঢাকার ভাটারার বসুন্ধরার জি ব্লক এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।

এসময় পুলিশ জানায়, ফরিদপুর সদর উপজেলার সাবেক এই চেয়ারম্যান ক্ষমতায় থাকাকালে দলীয় ক্ষমতা এবং তার ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে নানারকম অসুদপায় অবলম্বন করেছেন। সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফরিদপুরের সবধরনের টেন্ডার থেকে কমিশন বাণিজ্য এবং চাকরি বাণিজ্য করে দেশেবিদেশে অঢেল সম্পত্তি অর্জন করেন তিনি। ২০২০ সালে বিশেষ অভিযান পরিচালনাকালে তার ছত্রছায়ায় হাতুড়ি বাহিনী এবং হেলমেট বাহিনী আত্মগোপনে চলে যায়।

পরে সিআইডি’র দায়েরকৃত ডিএমপির কাফরুল থানার মামলায় তদন্ত শেষে তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

এদিকে, ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা খন্দকার বাবরের গ্রেপ্তারে শহরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেন। গত মঙ্গলবার বিকালে দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল বের হয়ে শহরের জনতা ব্যাংকের মোড়ে সমাবেশ করেন তারা। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম হকের সভাপতিত্বে এসময় উপস্থিত ছিলেন- ফরিদপুরের পৌর মেয়র অমিতাভ বোস, শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মনিরুল হাসান মিঠু, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়াউল হাসান মিঠু, জেলা আওয়ামী মহিলা লীগের সভাপতি মাহমুদা বেগম, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তামজিদুল রশিদ চৌধুরী রিয়ান প্রমুখ।

এসময় বক্তারা বলেন, ফরিদপুরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে অত্যাচার অবিচার হয়েছে তার গডফাদার এই বাবর। সকল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

জেলা সদরের গোয়ালকান্দির বাসিন্দা বাবর দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তিনি একজন পোল্ট্রি ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রথম জীবনে তার বিরুদ্ধে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেন ফরিদপুরের আওয়ামী লীগের নেতারা। তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননারও অভিযোগ করেছেন নেতারা।

১৯৯১ এর নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে প্রার্থী হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ এর নির্বাচনে তিনি নৌকার প্রার্থী তার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিপক্ষে নির্বাচন করেন। ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে পরের বছর ২০১০ সালে বাবর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হন।

এরপর তিনি ফরিদপুরের ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়ে ব্যাপকভাবে তৎপরতা শুরু করেন। ২০১৪ সালে তিনি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তিনি ওই নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হন বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর সদর উপজেলাকেন্দ্রীক নিজস্ব স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে দলের রাজনীতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন তিনি। এসময়ে তার বিরুদ্ধে ফরিদপুরের সবধরনের উন্নয়ন কাজের টেন্ডার হতে কমিশন ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরির বিনিময়ে কমিশন বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ ওঠে।

২০১৫ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হন। ২০১৭ সালে ওই পদ হতে বহিষ্কৃত হন। এরপর তিনি ফরিদপুরের রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন।

এলাকাবাসী জানায়, একসময় ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন বাবর। ২০০৮ সালে তার ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলে তিনি ভাইয়ের পক্ষে কাজ করেন।

তারা আরও জানায়, নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর খন্দকার মোশাররফ প্রথমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী হন। পরে তিনি শ্রমমন্ত্রী হন। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হন বাবর। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন এবং আওয়ামী লীগে তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাসপোর্ট অফিস, সড়ক বিভাগ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের টেন্ডার বাবরের নির্দেশ ছাড়া কেউ পেতেন না। কোনো কাজ করতে গেলে তাকে ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো।

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শামসুল হক ওরফে ভোলা মাস্টার বলেন, ‘বাবর বিএনপি ঘরানার রাজনীতি করতেন। খন্দকার মোশাররফ টাকাপয়সা কামাইয়ের জন্য বাবরকে দলে টেনে আনেন। বাবর যেহেতু বিএনপির রাজনীতি করতেন, সেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে বিএনপির লোকদেরই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, বিনিময়ে নিজের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের প্রতি মামলা-হামলা করে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে দল হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ।’

তার ধারণা, যত দিন নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল, সরকারি অফিসে যে পরিমাণ টেন্ডারবাজি হয়েছে, তাতে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বাবর।

শামসুল হক বলেন, ‘আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। পরেরবার বাবর ওই পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়েই তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এমন অনেক প্রকল্প সৃষ্টি করেছেন, যার কাজ না করে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন খন্দকার বাবর। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সুবল চন্দ্র সাহা। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী শেখ মাহাতাব আলীর কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে তাকে সমর্থন দিয়ে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে সার্বিক ভূমিকা পালন করেছেন বাবর। ২০১৪ সালে তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন বাবর।

২০১৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য বহু দেনদরবার করে ব্যর্থ হন বলে ফরিদপুরের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে। পরে অবশ্য তাকে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি করা হয়।

অভিযোগ আছে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে সফরসঙ্গী দলের আইনবিষয়ক সম্পাদক বদিউজ্জামানসহ ২০১৬ সালে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে ফুল দিতে যান সৈয়দ মাসুদ হোসেন। ফেরার পথে বদিউজ্জামানকে কুপিয়ে জখম করা হয় এমন অভিযোগ উঠে বাবরের বিরুদ্ধে।

এছাড়া তার নির্দেশে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শওকত আলী জাহিদ ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেনের ওপর হামলার অভিযোগ আছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাবরের নির্দেশে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সন্ত্রাসী হত্যা করার জন্য আমার ওপর হামলা চালায়। আমাকে জখম করে। সৌভাগ্যবশত বেঁচে যাই।’এ হামলার ঘটনায় নূর মোহাম্মদ মামলা করেছিলেন।

এছাড়া, ২০২০ সালের ১৬ মে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে একটি হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ মে মামলা করেন সুবল সাহা। এ মামলার সূত্র ধরে ওই বছরের ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে খন্দকার মোশাররফের দুই শিষ্য আলোচিত ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেল গ্রেপ্তার হন। এরপর রাজনীতি থেকে বাদ পড়েন খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

বরকত ও রুবেলের নামে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় মামলাটি করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ।

গত ২০২১ সালের ৩ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) উত্তম কুমার সাহা ১০ জনের বিরুদ্ধে সিএমএম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি খন্দকার বাবর।

এদিকে, বাবরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সঠিক তদন্ত করে বিচারের ব্যবস্থা নেয়া হলে দেশে আইনের শাসনের একটি উদাহরণ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন।

অভিযোগপত্রে বাবর, রুবেল, বরকত ছাড়াও আরো যাদের নাম আছে তারা হলেন- ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান, সাবেক মন্ত্রীর এপিএস এএইচএম ফুয়াদ, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ওরফে ফাহিম, যুবলীগ নেতা কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলি মিনার ও তারিকুল ইসলাম নাসিম।

১০ আসামির মধ্যে এ নিয়ে কারাগারে থাকা রুবেল-বরকতসহ গ্রেপ্তার হলেন আটজন। এর মধ্যে জামিনে আছেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী ও শহর যুবলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ফারহান। মুহাম্মদ আলী দিদার ও তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম এখনও পলাতক।

জানা গেছে, বরকত-রুবেলকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের সকল অসৎ কর্মের গডফাদার হিসেবে নাম পাওয়া যায় বাবরসহ অন্যদের।

Back to top button